বঙ্গবন্ধুর চোখে প্রথম স্বাধীন বাংলাদেশ
ওয়াহেদ বুল বুল অর্পনঃ মহাকালের মহাবিষ্ময়, বাংলার মুক্তিকামী মানুষের মুক্তির রুপকার, বাংলার শোষিত মানুষের স্মজন ও বাংলার রাখাল রাজা, মহাকালের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলা ও বিশ্বের দর্শনে শুধু একটি নাম নয়। একটি ইতিহাস, একটি ভবিষ্যত ও বিপ্লবী অতীত। এই বাংলাদেশে দল-মত ও সংগঠন নির্বিশেষে তিনি সবার ভালবাসা ও শ্রদ্ধার এক উন্মেষিত গোলাপ। উদ্ভাসিত এক নক্ষত্র। বঙ্গবন্ধুর কথা কবিতার মতো বললে এমন বলা যায়—
তোমার স্মৃতি কি সূর্যের মত জ্বলে?
বাংলার পথে পথে তারা কথা বলে।
তোমার বুকের মানচিত্রের কাছে
উজ্জ্বল সেই আগামী দিনটি জ্বলে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর শত্রু বাহিনীর বন্দীশালা থেকে ফিরে এলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধু প্রথম যে দিন তার চোখে দেখা স্বপ্নের স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে পা রেখেছিলেন, সেদিন তিনি স্বপ্নের স্বাধীন বাংলা-মাটি-মানুষ-রক্ত-লাশের স্তূপ দেখে নিজেকে সংগোপন রাখতে পারেননি।
সেদিন জাতিরপিতা কেঁদেছিলেন অঝরে কেঁদেছিলেন। সেই স্বপ্নের দিনটি ছিল ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি। তেজগাঁও বিমানবন্দরে অবতরণ করল বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে আসা বিমান। ঘড়ির কাঁটায় তখন ঠিক ১টা ৪১ মিনিট। কানে ভেসে আসছিল একটি স্লোগান জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু। মানুষের মুখে মুখে প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল বিমান বন্দর। এই সুর আকাশে বাতাসে যেন অনুভূতি নিয়ে বলে বাংলার মানুষকে, ভালবাসার মানুষটি তোমাদের মাঝে এসে গেছেন। বঙ্গবন্ধু নামলেন বিমান থেকে, বাংলার প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদ অশ্রু ভরা চোখে ফুল দিয়ে বরণ করলেন বিশ্ব নেতাকে। বঙ্গবন্ধু তার প্রিয় তাজউদ্দীনকে বুকে চেপে ধরে অঝরে কাঁদতে লাগলেন। শিশুর মত কাঁদছিলেন বঙ্গবন্ধু ও তার প্রিয় তাজ।
কী এক অসাধারণ মায়াবী দৃশ্য। হয়তবা সেদিন যারা ছিলেন উপস্থিত, তারা দেখেছিলেন মায়াবী সেই বঙ্গবন্ধুকে, তাদের হৃদয়পটে আজও সে দৃশ্য প্রজ্বলিত এক স্মৃতি হয়ে ঘুরে বেড়ায়। অমসৃণ-কঠিন-দুঃসাহসিক পথ পেরিয়ে, নিশ্চিত মৃত্যু থেকে যখন আপন সন্তান একটি স্বাধীন বাংলাদেশ নিয়ে ফিরলেন, তখন একজন বঙ্গবন্ধুর পিতা কি আর বসে থাকতে পারেন?
সেদিন বিমানবন্দরে বঙ্গবন্ধুর পিতা শেখ লুৎফর রহমান এসেছিলেন। ভালোবাসা-মমতা আর মায়াবী অশ্রু নিয়ে আপন সন্তানকে এক নজর দেখতে বঙ্গবন্ধু পিতা শেখ লুৎফুর রহমান ছুটে এসেছিলেন সেদিন।
বঙ্গবন্ধু পিতা শেখ লুৎফর রহমান এমন একজন পিতা ছিলেন, যিনি তার সন্তানকে নৈতিকতা ও আদর্শিকতা শিক্ষা দিয়েছিলেন। তিনি সন্তানকে খাঁটি দেশপ্রেমিক মানুষ হিসেবে গড়ে তুলেছিলেন। তিনি এমন একজন আদর্শ পিতা, যিনি আপন সন্তানকে সমর্থন দিয়েছিলেন ন্যায়ের পক্ষে থেকে অন্যায়ের বিপক্ষে দাঁড়াতে, জুগিয়েছেন অকৃত্রিম সাহস। সন্তান নির্যাতনের শিকার হয়েছেন, জেল খেটেছেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু পিতা বড় মুখ করে বলেছেন, “আমার ছেলে ন্যায়ের জন্য লড়াই করে জেলে গেছে।“
পিতা এমন না হলে কী সন্তান মহাকালের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু হতে পারতেন? নিশ্চয়, পারতেন না।
বিমানবন্দর কানায়-কানায় পরিপূর্ণ, শেখ সাহেবকে একনজর দেখতে আসা মানুষের ঢলে ভেসে যাচ্ছিল বিমানবন্দর। সেখান থেকে মানুষ আর মানুষ পেরিয়ে বঙ্গবন্ধু আসলেন ঐতিহাসিক সেই রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান)। মঞ্চে উঠেই বিশাল জনসমুদ্রের সামনে দাঁড়িয়ে অঝরে কাঁদলেন বঙ্গবন্ধু। দুহাতে মহাকালের মহানায়ককে বারবার চোখ মুছতে দেখা যাচ্ছিল।
সেদিন শুধু জাতির পিতা কাঁদেননি! বঙ্গবন্ধুর কান্নায় কেঁদেছেন উপস্থিত লাখো মানুষ। তারপর আবেগী বজ্রকন্ঠে দরাজ গলায় বঙ্গবন্ধু বললেন, “আমি আপনাদের কাছে দু-এক কথা বলতে চাই। আমার বাংলাদেশ আজ স্বাধীন হয়েছে, আমার জীবনের সাধ আজ পূর্ণ হয়েছে, আমার বাংলার মানুষ আজ মুক্ত হয়েছে। আমি আজ বক্তৃতা করতে পারব না।“
এ সময় বঙ্গবন্ধুর গলা বারবার আবেগী হয়ে আসছিল। সেদিন বঙ্গবন্ধু তার চোখে দেখেছিলেন বাংলার মানুষের স্বাধীনতা-মুক্তির আনন্দে হাস্যোজ্জ্বল লাখো মানুষের মুখ।
নয় মাসের দূরপ্রসারিত লড়াই, লাখো প্রাণের রক্ত, মা-বোনের সম্ভ্রম হারানোর বিনিময়ে অর্জিত বাংলার মুক্তিকামী মানুষের স্বাধীনতায় যেমন বিরহ কষ্ট ছিল, ছিল গোলামি থেকে মুক্তির আনন্দ। একদিকে কঠিনতম, দুঃখ, অন্যদিকে চূড়ান্ত বাংলা বিজয়ের খুশি। দুঃখ-কষ্টের সেই খাঁড়িতে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধু বললেন, “আজ প্রায় ৩০ লাখ মানুষকে মেরে ফেলা হয়ে হয়েছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, প্রথম বিশ্বযুদ্ধেও এত মানুষ, এত সাধারণ জনগণের মৃত্যু হয়নি, শহীদ হয়নি, যা আমার ৭ কোটির বাংলায় করা হয়েছে। আমি জানতাম না, আমি আপনাদের কাছে ফিরে আসব। আমি শুধু একটা কথা বলেছিলাম, তোমরা যদি আমাকে মেরে ফেল, কোন আপত্তি নেই, মৃত্যুর পরে তোমরা আমার লাশটা আমার বাঙালির কাছে দিয়ে দিয়ো—এই একটা অনুরোধ তোমাদের কাছে।“
বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেছা মুজিব সেদিন রেডিওতে সরাসরি সম্প্রচার শুনছিলেন ধানমন্ডির একটি বাসায়। বেগম মুজিব শত কষ্ট বুকে চেপে রেখেও বাংলার মানুষের জন্যে বঙ্গবন্ধুর সংগ্রামে স্বামীর ত্যাগ ও ভালোবাসার পথটা ক্ষণিকের জন্যও আটকে দেননি। বঙ্গমাতা দিয়েছেন প্রেরণা। বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’–তে বঙ্গমাতার সেই আত্মত্যাগ-প্রেরণার কথা বারবার এসেছে।
বঙ্গবন্ধু বললেন, “বাংলার ছেলেরা, বাংলার মায়েরা, বাংলার কৃষক, বাংলার শ্রমিক, বাংলার বুদ্ধিজীবী যেভাবে সংগ্রাম করেছে, আমি কারাগারে বন্দী ছিলাম, ফাঁসিকাষ্ঠে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত ছিলাম। কিন্তু আমি জানতাম আমার বাঙালিকে দাবায় রাখতে পারবে না।“
সারাজীবন বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশকে কেমন দেখতে চেয়েছিলেন? হয়তবা চেয়েছিলেন, বাংলার শোষিত মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে। বঙ্গবন্ধুর একটিই অপূর্ণ স্বাধ ছিল, হইয়তবা তা ছিল, বাংলাদেশের শোষিত-নির্যাতিত মানুষের মুক্তি-স্বাধীনতা।
এ জন্যে সেদিন স্বাধীন বাংলাদেশে তার চোখে বাংলাদেশ ও বাংলার মানুষকে দেখে বুক চিরে বেরিয়ে আসা কথাগুলো তিনি এভাবে বলেছিলেন, “আমি আজ বাংলার মানুষকে দেখলাম, বাংলার মাটিকে দেখলাম, বাংলার আকাশকে দেখলাম, বাংলার আবহাওয়াকে অনুভব করলাম। বাংলাকে আমি সালাম জানাই, ‘আমার সোনার বাংলা, তোমায় আমি বড় ভালোবাসি বোধ হয় তার জন্যই আমায় ডেকে নিয়ে এসেছে।“
সেদিন বঙ্গবন্ধুর চোখে ভেসেছিল সাড়ে সাত কোটি বাংলার স্বাধীন মানুষ। একটি স্বাধীন বাংলাদেশ। হয়তবা এজন্যেই এই মহাকালের মহানায়ক চিরন্তন হয়ে থাকবেন ইতিহাস ও বাংলার বিপ্লবী অতীতের গৌরবময় পৃষ্ঠায়।