375 - 375Shares
নাছির ইসলাম শান্তঃ বর্তমান প্রেক্ষাপটে রাজনীতি হচ্ছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। রাজনীতি ছাড়া কোনো দেশ বা জাতি সঠিক পথে চলতে পারবে না। দেশ হোক বা সমাজ দুই ক্ষেত্রেই রাজনীতি অনেক ভূমিকা পালন করে। আর এই রাজনীতিটা শুরু হয় ছাত্র রাজনীতি দিয়ে। আমাদের দেশের রাজনীতির একটা বড় অংশ ছাত্র রাজনীতির দখলেই থাকে।

ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও যৌক্তিক আন্দোলন সংগ্রামে ছাত্র রাজনীতি বা ছাত্রলীগ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। দেশের সুবিধা-অসুবিধা সরকারের কাছে তুলে ধরতে ছাত্ররাই সবার আগে সিদ্ধান্ত নেয়।
আর আজকে সেই ছাত্র রাজনীতিকে সমাজের কিছু সংখ্যক মানুষ বন্ধ করার দাবি জানাচ্ছে। তারা জনগনকে বিভিন্ন মাধ্যমে বোঝাচ্ছে স্কুল-কলেজে কোনো ছাত্র রাজনীতি চলবে না, শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররাই ছাত্র রাজনীতি করার সুযোগ পাবে। গ্রামে একটা কথা আছে- গরীবের বউ সবার ভাউজ ৷ ভাউজ মানে হলো ভাবি৷ বাংলাদেশের রাজনীতিতে ছাত্র রাজনীতি হলো তেমন গরীবের বউ৷ কিছু ঘটলেই দোষ পড়ে ছাত্র রাজনীতির ঘাড়ে৷ কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কিছু ঘটলেই দাবি ওঠে ছাত্র রাজনীতি বন্ধের৷ এই প্রবণতা নতুন নয়৷ অনেকদিন ধরেই চলে আসছে৷
ক্ষমতাসীন দলের সমর্থিত ছাত্র সংগঠনের নেতারা যখন হত্যা, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজিতে জড়িয়ে পড়েন; তখনই সবাই আওয়াজ তোলেন ছাত্র রাজনীতি বন্ধের৷ কিন্তু ক্যাসিনো কেলেঙ্কারি ফাঁস হওয়ার পর কেউ কি একবারও যুব রাজনীতি বন্ধের দাবি তুলেছেন?
বাংলাদেশের রাজনীতিবিদদের অনেকেই যে হত্যা, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, ব্যাংক লুট, শেয়ারবাজার কারসাজির সাথে জড়িত,কেউ কি একবারও রাজনীতি বন্ধের দাবি তুলেছেন, ভুলেও ভেবেছেন? আচ্ছা বাদ দেন রাজনীতি৷ বাংলাদেশের কোন পেশার মানুষের মধ্যে অবক্ষয় নেই-পুলিশ, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, সাংবাদিক; কোনো পেশায় বেশি,কোনো পেশায় কম,তাই বলে কি কোনো পেশা বন্ধের দাবি উঠেছে? সব দোষ তাহলে ছাত্ররাজনীতির হবে কেন?
এখন দেশে একটা বিপদজনক রাজনীতিবিমুখ প্রজন্ম বেড়ে উঠছে৷ জিজ্ঞেস করলেই তারা স্মার্টলি জবাব দেয়, আমি রাজনীতি পছন্দ করি না৷ শুধু নতুন প্রজন্মই নয়, সব বয়সের মানুষের মধ্যেই রাজনীতি নিয়ে এক ধরনের অনীহা কাজ করে৷ এমনকি আমার ছোট ভাই আর পরিবারের বাকি সদস্যরাও ছাত্র রাজনীতি পছন্দ করেন না। ভয় পায়, শুধু আমার পরিবার না, সাধারণ মানুষ ও রাজনীতিকে এক ধরনের ভয় পায়৷ তাই দূরে থাকে৷ এখন আর কেউ চান না, তার সন্তান ছাত্ররাজনীতি করুক৷
আর এদিকে মন্ত্রী-এমপি-নেতা-আমলারা তো তাদের সন্তানদের বিদেশেই পড়ান৷ তাই দেশ, রাজনীতি, ছাত্ররাজনীতি গোল্লায় গেলে তাদের যেন কিছু যায় আসে না৷ এই প্রবণতা দেশ ও জাতির জন্য বিপদজনক৷ তাহলে কি আমরা নিজেরা রাজনীতি থেকে দূরে থাকবো আর জেনেশুনে দুর্বৃত্তদের হাতে দেশটা লুটিয়ে দিয়ে দেবো?
ব্যাপারটা যদি এমন হয়, মেধাবীরা সব বিসিএস ক্যাডার হবে, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হবে বা ভালো চাকরি নিয়ে বিদেশে চলে যাবে আর ছাত্র হিসেবে খারাপ এবং স্বভাবে মাস্তানরাই শুধু রাজনীতি করবে, তাহলে আমাদের কপালে সত্যি খারাপ কিছু আছে৷
কারণ ব্যাপারটা খুব সহজ, সাধারণ নিয়মে যারা রাজনীতি করবে, তারাই ভবিষ্যতে এমপি হবে, মন্ত্রী হবে; রাষ্ট্রের নীতি নির্ধারণ করবে৷ একটু কল্পনা করুন, ক্লাসের মেধাবী ছাত্রটি বিসিএস দিয়ে প্রশাসন ক্যাডারে গেল আর মাঝারি মানের ছাত্রটি রাজনীতি করলো৷ যে ক্যাডার সার্ভিস এ গেল সে প্রমোশন পেতে পেতে সচিব হলো৷ আর মাঝারি ছাত্রটি ধাপে ধাপে মন্ত্রী হলো৷ এখন মন্ত্রণালয়ের নীতিগত সিদ্ধান্ত কিন্তু মন্ত্রীই নেবেন, সচিব তা কার্যকর করবেন শুধু৷ তার মানে কম মেধাবীরা সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন, আর বেশি মেধাবীরা তা কার্যকর করছেন৷ ব্যাপারটা যদি উল্টো হতো যদি মেধাবীরা নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয়ার জায়গায় থাকতো, তাহলে তো দেশ ও জাতির জন্য আরো কল্যাণকর হতো৷আমি বলছি না, সব ছাত্রকেই রাজনীতি করতে হবে৷ যার রাজনীতি ভালো লাগে সে রাজনীতি করবে, যে একাডেমিকভাবে ভালো করতে চায়, সে তাই করবে৷ কিন্তু ছাত্র রাজনীতির বন্ধের নামে রাজনীতি করতে চান, এমন একজন ছাত্রের সামনে একটি অপশন বন্ধ করে দেয়া মানে তো তার স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ৷
১৮ বছর বয়সীরাই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েন৷ তারা ভোট দিতে পারবেন, কিন্তু রাজনীতি করতে পারবেন না, এ কেমন বৈপরীত্য!এই অভিজ্ঞতাটা আমার নিজের,আমার আম্মু আমাকে ভোট দিতে ভোটার কেন্দ্রে যেতে বলে অন্যদিকে রাজনীতি থেকে সব সময় দূরে রাখার চেষ্টা করে।
আমরা যত সমালোচনাই করি, রাজনীতিবিদরাই দেশ চালান, নীতিনির্ধারণ করেন৷ সবচেয়ে খারাপ গণতন্ত্রও অন্য যে কোনো ব্যবস্থার চেয়ে ভালো৷ স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী আন্দোলনে নিজেদের মূল্যবান সময় ব্যয় করেছে হাজারো ছাত্র রাজনীতিবীদ। নিজেদের জীবনের একটা বড় অংশ এরা ছাত্র রাজনীতিতে ব্যায় করেছে৷ এক্ষেত্রে তাদের একাডেমিক ক্যারিয়ারের কিছুটা ক্ষতি হয়েছে বটে, কিন্তু তারা এখন পর্যন্ত জীবনের সবচেয়ে বড় শিক্ষাটা পেয়েছে সেই রাজনীতি থেকেই৷ নিজের যৌবন এরশাদ বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে ব্যয় করতে পেরেছে বলে আজ তারা সবসময় নিজেদের নিয়ে গর্ববোধ করে৷
ছাত্র রাজনীতি একজন ছাত্রকে সাহসী করে, দায়িত্বশীল করে, স্বার্থপরতার উর্ধ্বে উঠে ভাবতে শেখায়৷ জীবনের সমস্যাগুলো সাহসের সাথে মোকাবেলা করতে শেখায়৷ তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নিতে শেখায়৷ সবচেয়ে বড় কথা হলো, নেতৃত্ব দিতে শেখায়৷ একজন রাজনৈতিক কর্মী কখনোই তার সহযোদ্ধাকে বিপদে ফেলে পালাবে না৷
একজন রাজনৈতিক কর্মী কখনোই একা কিছু খাবে না, কেউ কারাগারে গেলে বা পালালে তার পরিবারের পাশে দাঁড়াবে৷ এরশাদবিরোধী আন্দোলন করতে গিয়ে অনেকবার পুলিশের সাথে ছাত্র জনতার বহুবার সংঘর্ষ হয়েছে৷ তারপরও ভয়ে পালিয়ে যায় নাই তারা। জীবনকে তারা বড় করে দেখেছে, মোকাবেলা করেছে ছাত্র রাজনীতি থেকে প্রাপ্ত জ্ঞান দিয়ে।
মানুষের জীবনটা শুধু হেসে খেলে, বিয়ে করে, বাচ্চা পুষে পার করে দেয়ার জন্য নয়৷ জীবনের আরো মহত্তর লক্ষ্য আছে৷ আছে সমাজকে, রাষ্ট্রকে, বিশ্বকে আরো ভালোর পথে বদলে দিতে আপনার জীবনকে কাজে লাগানোর চেষ্টা৷ এখন রোবটেরও বুদ্ধি আছে, কিন্তু মানুষ রোবট নয়৷ গাছেরও জীবন আছে, কিন্তু মানুষ গাছ নয়৷ মানুষ সৃষ্টির সেরা৷ কারণ মানুষের জীবন আছে, বুদ্ধি আছে, বিবেক আছে, বিবেচনা আছে৷ এই পৃথিবীকে আরো বাসযোগ্য করতে, আরো উন্নত করতে সে তার আদর্শকে কাজে লাগাবে৷ ভালোর সাথে মন্দের পার্থক্য করবে৷ একজন ছাত্রের মধ্যে সেই আদর্শিক চেতনার বীজ বুনে দেবে ছাত্র রাজনীতি৷
বাংলাদেশে ছাত্র রাজনীতির উজ্জ্বল ঐতিহ্য রয়েছে৷ ৫২এর ভাষা আন্দোলন, ৬২এর শিক্ষা আন্দোলন, ৬৯এর গণঅভ্যুত্থান, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে ছাত্র আন্দোলনের গৌরবজনক ভূমিকা রয়েছে৷ কিন্তু ৯০ সালে স্বৈরাচারের পতনের মাধ্যমে গণতন্ত্রের যে নতুন অভিযাত্রা শুরু হয়েছে, তার সময় থেকেই শুরু হয়েছে ছাত্র রাজনীতির পচন৷ এরশাদের আমলে চারবার ডাকসু নির্বাচন হলেও, স্বৈরাচার পতনের পর ২৮ বছর আটকে ছিল ডাকসু নির্বাচন৷
এরপর দীর্ঘ ২৮ বছরের দীর্ঘ প্রতিক্ষা শেষে বিশাল প্রত্যাশা নিয়ে বছর খানেক আগে ডাকসু নির্বাচন হলেও তা আশানুরূপ প্রত্যাশা মেটাতে পারেনি৷ ডাকসু নির্বাচন হলেও অন্য বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্র সংসদ নির্বাচনের যে আশা জেগেছিল, তা পূরণ হয়নি৷ ছাত্র সংসদ নির্বাচন না হওয়ায় নেতৃত্ব বাছাইয়ের পাইপ লাইনটা আমরা আটকে রেখেছি৷ সুস্থতার পাইপ লাইনটা বন্ধ করে আমরা অসুস্থতার আমদানি করেছি অবাধে৷
যেখানে এরশাদের আমলেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে গণতান্ত্রিক সব ছাত্র সংগঠনের সহাবস্থান ছিল৷ তখন তারা জানতো বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের উত্তর পাড়া ছাত্রদলের দখলে আর দক্ষিণ পাড়া ছাত্রলীগের৷ হলে হলে আলাদা ছাত্র সংগঠনের আধিপত্য ছিল৷ কিন্তু গণতান্ত্রিক অভিযাত্রায় পা রাখার পর থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে গেছে এককেন্দ্রিক৷ এখন যখন যে দল ক্ষমতায় থাকে, ক্যাম্পাসে শুধু তাদের তৎপরতাই থাকে৷ বাকিরা রীতিমত নিষিদ্ধ৷ যেমন এখন ছাত্রলীগের একক নিয়ন্ত্রণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্যাম্পাস৷ ছাত্রদলের কোনো অস্তিত্ব নেই৷ আবার যখন বিএনপি ক্ষমতায় ছিল তখন ছিল উল্টো চিত্র৷ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার বদলের সাথে সাথে রাতারাতি বদলে যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চিত্র৷
শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নয়, দেশের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের চিত্রই একই৷ তবে এটা জনপ্রিয়তায় বা ভালোবাসায় নয়; গায়ের জোরে ভয় দেখিয়ে৷ সমস্যাটা এখানেই৷ ছাত্রলীগের মাস্তানী, চাঁদাবাজি, দখলবাজিকে আমরা ছাত্র রাজনীতির সমস্যা ভেবে বসে আছি৷ ১৮ থেকে ২৫- এই বয়সটাই অন্যরকম৷ এই সময় মানুষ কিছু না কিছু করার জন্য উদগ্রীব হয়ে থাকে৷ সবাই তখন ‘আমি বিদ্রোহী রণক্লান্ত, আমি সেই দিন হবো শান্ত…’এর মত বিদ্রোহী; সবাই তখন মিছিলে যাওয়ার জন্য, যুদ্ধে যাওয়ার জন্য এক পায়ে খাড়া৷ তারুণ্যের সেই শক্তিকে গঠনমূলক কাজে লাগাতে না পারলেই বরং বিপদ৷
আমরা আগে দেখেছি, যে সব প্রতিষ্ঠানে ছাত্র রাজনীতি নেই, সেখানেই জঙ্গীবাদের চাষবাস হয়েছে৷ ছাত্র রাজনীতি বন্ধ করে আমরা কি তবে দেশজুড়ে জঙ্গীবাদের বিস্তার ঘটাবো? অনেকেই বলেন, এখন আর ছাত্র রাজনীতির কোনো লক্ষ্য নেই, তাই এর দরকারও নেই৷ এটা ঠিক ভাষার দাবি, শিক্ষার দাবি, স্বৈরাচার পতনের দাবি, সমাজ বদলের দাবি- এমন কোনো মহৎ উদ্দেশ্য নেই তাদের সামনে৷ অবশ্য একেবারে কোনো লক্ষ্য নেই তা বলা যাবে না৷ এই যে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গেস্টরুম, টর্চার সেল, র্যাগিংয়ের কথা শুনি, সুস্থ ধারার ছাত্র রাজনীতি থাকলে কোনোভাবেই এটা সম্ভব হতো না৷
এখনও বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নানান সমস্যা আছে৷ সেই সব সমস্যা সমাধানে ছাত্র নেতারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারেন৷ এছাড়া গণতন্ত্রের দাবি, ভোটাধিকারের দাবি, মতপ্রকাশের স্বাধীনতার দাবি আদায়েও ছাত্ররা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে৷ এখন আওয়ামী লীগের লেজুড় হয়ে গেছে বটে, তবে ছাত্রলীগের জন্ম কিন্তু আওয়ামী লীগেরও আগে৷ আর ছাত্রলীগের রয়েছে গৌরবের দীর্ঘ ঐতিহ্য আর সোনালী সময়ের ইতহাস৷
কিন্তু গত ১০ বছরে ছাত্রলীগ নানা কারণে আলোচনা সমালোচনার শীর্ষে৷ বুয়েটের শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদকে পিটিয়ে হত্যার পর এখন জানা যাচ্ছে, ছাত্রলীগের নেতৃত্বে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে টর্চার সেল আছে৷ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির কাছে চাঁদা চেয়ে পদ হারিয়েছেন ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক৷ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির কাছে চাঁদা চেয়েছে বলেই না সেটা প্রধানমন্ত্রীর কান পর্যন্ত গিয়েছে৷
এমনিতে ছাত্রলীগৈর নেতারা গত দশকজুড়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গুলোতে যে রাজত্ব কায়েম করেছে, তার খবর কিন্তু সাধারণ মানুষ জানে৷ ছাত্রলীগের মত ঐতিহ্যবাহী সংগঠনের নামে এখন গুগলে সার্চ দেয়া হলে যা আসে সব নেতিবাচক সংবাদ৷ হত্যা, ধর্ষণ, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি সহ নানা ধরনের ঘৃণিত অপরাধে তাদের নাম জড়িয়ে যাচ্ছে৷ ছাত্রলীগ এখন আর আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন নয়, বোঝা হয়ে গেছে৷ তবে আমি ছাত্রলীগকে পুরো দোষ দেই না৷ তাদেরকে নিয়ন্ত্রণ করার কি কেউ নেই দেশে?
দেশের বিভিন্ন স্থানে মূল দলের নেতারাই ছাত্রলীগকে তাদের অপকর্মের লাঠিয়াল হিসেবে ব্যবহার করে৷ আর দোষ হয় ছাত্রলীগের একার৷ কারা ছাত্রলীগকে দানব বানালো, সেটাও দেখা দরকার৷ বুয়েটের যে ছাত্ররা সহপাঠী আবরারকে পিটিয়ে মারলো, তারা সবাই কিন্তু এলাকায় নম্র, ভদ্র হিসেবে পরিচিত৷ সেই ,মেধাবী ছাত্রগুলো কিভাবে বুয়েটে এসে এমন খুনী হয়ে গেল, বুয়েট কর্তৃপক্ষ কি একবারও ভেবে দেখেছেন? মানলাম ছাত্রলীগাররা বিভিন্ন ক্যাম্পাসে রাজত্ব কায়েম করেছে৷ কিন্তু তাহলে প্রভোস্ট, প্রক্টর, ভিসিরা কী করেন? তারা কেন আটকান না ছাত্রলীগকে? আটকান না, কারণ সেই শিক্ষকরাও দলীয় রাজনীতির বিষে নীল৷ ছাত্র আর শিক্ষকরা যেন মাসতুতো ভাই৷
সমস্যা হলো, ছাত্রলীগের বিভিন্ন অপকর্মকে কিংবা বিচ্ছিন্ন ঘটনাকে কেন্দ্র করে, রাজনীতির সঙ্কট মনে করে একটি মহল ছাত্র রাজনীতি বন্ধের ষড়যন্ত্রে মেতে উঠেছে৷ মাথা ব্যথা হলে মাথা কেটে ফেলা কখনোই সমাধান নয়৷ ছাত্র রাজনীতি বন্ধের চেষ্টা আসলে বিরাজনীতিকরণেরই চেষ্টা৷
ছাত্ররা রাজনীতি না করলে, ভবিষ্যৎ নেতৃত্বের জন্য তৈরি না হলে কারা দেশের নেতৃত্ব দেবে? অবসরপ্রাপ্ত সামরিক-বেসামরিক আমলা, ব্যবসায়ী, কালোবাজারি আর দৃর্বৃত্তরা? কেউ কেউ মনে হয় সেটাই চাইছেন৷ ছাত্র রাজনীতি করলেই কেউ রসাতলে যাবে, এমন ভাবার কারণ নেই৷
১৯৮০ সালে নয়াদিল্লীর জওহারলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় ছাত্র আন্দোলনে জড়িত থাকার দায়ে পুলিশী নির্যাতনের শিকার হয়ে পড়ে ১০ দিন তিহার জেলেবন্দী ছিলেন অভিজিৎ বন্দোপাধ্যায়, যিনি এবার অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন৷ অতদূরে যাওয়ার দরকার কি ছাত্রলীগের প্রথম আহ্বায়ক নইমুদ্দিন আহমেদ পরে আপিল বিভাগের বিচারক হয়েছিলেন৷ তত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক প্রধান উপদেষ্টা ও সাবেক প্রধান বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান ভাষা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছিলেন৷ ছাত্র রাজনীতি করে পরে সাফল্যের সঙ্গে বিভিন্ন ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দিয়েছেন বা দিচ্ছেন এমন মানুষের সংখ্যা কম নয়৷ বরং যারা ছাত্র জীবনে রাজনীতি করেন, তারা পরে অন্য পেশায়ও নেতৃত্বের পর্যায়ে থাকেন৷ তাই ছাত্ররাজনীতিকে দোষ না দিয়ে, সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে, তার চিকিৎসা দিতে হবে৷ সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যাতে সব সংগঠন তৎপরতা চালাতে পারে, তা নিশ্চিত করতে হবে৷ ক্ষমতাসীন দলের সংগঠন যাতে সাধারণ ছাত্রদের ওপর নির্যাতন চালাতে না পারে, তা নিশ্চিত করতে হবে৷ সরকার চাইলেই সেটা সম্ভব৷
এদিকে সাধারণত ক্ষমতাসীনরা ছাত্র আন্দোলনকে ভয় পায়৷ তারা কোনো না কোনো ভাবে ছাত্ররাজনীতিকে দমিয়ে রাখতে চায়৷ সরকার যদি ছাত্ররাজনীতি বন্ধের চেষ্টা করতো, সবার উচিত হতো তার প্রতিবাদ করা৷ এখন হয়েছে উল্টো, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছাত্ররাজনীতির পক্ষে বলছেন আর যাদের ছাত্ররাজনীতির পক্ষে থাকার কথা সেই সুশীল সমাজ এর বিপক্ষে বলছেন৷ কি অদ্ভূত না ব্যাপারটা!
ছাত্ররাজনীতি নয়, অপরাজনীতি বন্ধ হোক চিরতরে৷ আর সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ফিরে আসুক শিক্ষা এবং ছাত্র রাজনীতির সুষ্ঠ পরিবেশ।
তরুণ লেখকঃ নাছির ইসলাম শান্ত
দ্বাদশ শ্রেণীর শিক্ষার্থী
পাহাড়তলী কলেজ, চট্টগ্রাম।
বে অব বেঙ্গল নিউজ / bay of bengal news
375 - 375Shares